অর্থনীতি

পাঁচ বছরে রাজশাহীতে ড্রাগনের আবাদ বেড়েছে ৩০ গুণ

সাগর নোমানী, বিশেষ প্রতিবেদক

ড্রাগন আমেরিকার একটি জনপ্রিয় ফল হলেও বর্তমানে বাংলাদেশেও এই ফলটির চাহিদা ও আবাদ বেড়েছে বহুগুণ। রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও কৃষিবিদদের ভাষ্যমতে, বরেন্দ্র অঞ্চলের উঁচু ভূমিতে সেচ সংকট, স্বল্প পরিচর্যা ও লেবার খরচ, সার ও কীটনাশকের ব্যবহার কম, অধিক উৎপাদন, দেশ-বিদেশে চাহিদা বৃদ্ধি ও রপ্তানির সম্ভবনাসহ প্রভৃতি ভালোমন্দের অঙ্ক কষে এ অঞ্চলের কৃষকরা এই ‘হাই ভ্যালু ক্রপ’টির চাষে ঝুঁকেছেন। চলতি মৌসুমে (২০২৩-২৪) ২২৩.৮৩ হেক্টর জমিতে ড্রাগনের আবাদ হয়েছে যা ২০১৯-২০ মৌসুমে ছিল মাত্র ৭.৫৬ হেক্টর। সেক্ষেত্রে গত পাঁচ বছরে ড্রাগনের আবাদ বেড়েছে প্রায় ৩০ গুণ।

কৃষি সম্প্রসারণ সূত্র জানায়, রাজশাহীতে সর্বপ্রথম গোদাগাড়ী উপজেলায় আধা হেক্টর জমিতে ড্রাগনের আবাদ হয়। ওই সময় গড় ফলন আসে হেক্টর প্রতি পাঁচ মেট্রিক টন ও মোট উৎপাদন দাঁড়ায় আড়াই মেট্রিক টন। এরপর ধীরে ধীরে দুই-তিন হেক্টর করে বাড়তে থাকে ড্রাগনের আবাদ। ২০১৯-২০ মৌসুমে রাজশাহীতে ৭.৫৬ হেক্টর জমিতে ড্রাগনের আবাদ হয়। এতে গড় ফলন আসে ১১.৯৩ মেট্রিক টন এবং মোট উৎপাদন দাঁড়ায় ৯০.২১ মেট্রিক টন। ২০২০-২১ মৌসুমে ২৭.০৮ হেক্টর জমিতে ড্রাগনের চাষ হয়। হেক্টর প্রতি গড় ফলন হয় ১১.৯৯ মেট্রিক টন। ওই বছরে মোট উৎপাদন দাঁড়ায় ৩২৪.৭৮ মেট্রিক টন। ২০২১-২২ মৌসুমে ড্রাগন ফলের চাষ বেড়ে দাঁড়ায় ৫৬.৭১ হেক্টর। এতে মোট উৎপাদন আসে ৬৮৮.৩ মেট্রিক টন। ২০২২-২৩ মৌসুমে ড্রাগনের আবাদ আরও বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ২১৩.৬ হেক্টর। এ বছর ফল উৎপাদন হয় চার হাজার ৩৬.৯৭ মেট্রিক টন। চলতি মৌসুমে রাজশাহীতে ড্রাগনের আবাদ হয়েছে (২০২৩-২৪) ২২৩.৮৩ হেক্টর। হেক্টর প্রতি গড় ফলন হয়েছে ২০.৬৪ মেট্রিক টন। মোট উৎপাদন হয়েছে চার হাজার ৬২০.১৩ মেট্রিক টন।

রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য প্রকানকারী কর্মকর্তা ও অতিরিক্তি উপপরিচালক আব্দুল্লাহ হিল কাফী দৈনিক অগ্নিবাণী প্রতিবেদককে বলেন, বাংলাদেশে সর্বপ্রথম ২০০৭ সালের দিকে থাইল্যান্ড, ফ্লোরিডা ও ভিয়েতনাম থেকে ড্রাফন ফলের বিভিন্ন জাত আমদানি করা হয়। এটি এক ধরনের ক্যাকটাস জাতীয় বৃক্ষ। এই গাছের কোন পাতা নেই। তবে ফুল ধরে। এই ফুল বিভিন্ন কীট-পতঙ্গ অথবা হাতের দ্বারা পরাগায়নের মাধ্যমে ফল আসে। ড্রাগন ফলের গাছ সাধারনত দেড় থেকে আড়াই মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। একটি ফলের ওজন কমপক্ষে ১৫০ থেকে ৬০০ গ্রাম পর্যন্ত হয়ে থাকে। এর বীজগুলো খুবই ছোট, কালো ও নরম। ড্রাগন ফলের খোসা সাধারণত লাল বর্ণের হয়। তবে এর ভেতরের মাংসল অংশটি গাঢ় গোলাপী, হলুদ ও সাদা বর্ণের হয়ে থাকে। এটি বেশ নরম, রসালো ও সুস্বাদু ফল। ড্রাগন ফল সাধারণ গরমের সময় বেশি ফলে। আর তাই শীতকালে গাছে ফল পেতে হলে লাইটিং এর ব্যবস্থা করতে হয়। আমেরিকা ছাড়াও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে ডাগ্রন ফলের চাহিদা ও জনপ্রিয়তা অনেক। বর্তমানে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইন্সিটিউট (বারি) কতৃক উদ্ভাবিত ড্রাগন ফলের নতুন জাতটি হচ্ছে বারি ড্রাগন-১।

আবাদ ও পুষ্টিগুণের ব্যাপারে কৃষিবিদ কাফী বলেন, রাজশাহী অঞ্চলের আবহাওয়া ও মাটির ধরন ড্রাগন চাষের বেশ উপযোগী। এছাড়াও এটি একটি মেডিসিনাল প্লান্ট। স্বল্প খরচ, অধিক উৎপাদনশীলতা, পর্যাপ্ত বাজার চাহিদা, ভিটামিন সি, মিনারেল, উচ্চ হাইফাইবার, ফ্যাট-এসক্যারোটিনের মতো পুষ্টিগুন। এতে জলীয় অংশ থাকে ৮৫.৩০ গ্রাম। তাছাড়া গøুকোজের পরিমাণ খুব কম থাকায় এটি ডায়াবেটিক্সের রোগীরা খেতে পারে। আবার ভালো দাম পাওয়ায় রাজশাহীতে ড্রাগন চাষে ঝুকছেন চাষীরা। একবার এই বাগান তৈরি পর সঠিকভাবে পরিচর্যা করলে প্রায় ১৫-২০ বছর পর্যন্ত এ বাগান টেকে। এর চারা তৈরিও খুবই সহজ। ডাল কেটে মাটিতে বপন করলেই এটি সুন্দর বেড়ে উঠে। তাই বাড়তি খরচের প্রয়োজন পড়ে না।

রাজশাহীর কৃষি সম্প্রসারণ দপ্তরের কৃষিবিদ শারমিন সুলতানা বলেন, সাদা, গোলাপী ও হলুদ রংয়ের ড্রাগন ফল চাষ হচ্ছে গোদাগাড়ীতে। তবে সাদা ড্রাগন ফলের উৎপাদন বেশি ও চাষাবাদে খরচ কম হওয়ায় এর আবাদ বেশি। তবে বাজার চাহিদা গোলাপী রংয়ের বেশি। তাই এটিও চাষ অনেক বেশি। তবে হলুদ রংয়ের ড্রাগনের দাম বেশি হওয়ায় এর আবাদ কম। গোদাগাড়ীর বিজয়নগর, ভাটোপাড়া, বিদিরপুর, মাটিকাটা, গ্রোগ্রাম, কাকনহাটসহ বিভিন্ন এলাকায় বেড়েছে ড্রাগনের চাষ। গোগ্রামে প্রায় ৭৫ বিঘা জমিতে চাষ করছেন হেদায়েতুল হেলাল। একই এলাকার বরশিপাড়ায় অন্তু ইসলাম চাষ করছেন ১২ বিঘায়। অন্যদিকে কাকন হাট এলাকায় প্রায় ১৬ বিঘা জমিতে ড্রাগনের চাষ করছেন আকবর আলী নামের আরেক ব্যক্তি। এছাড়াও আরো অনেকেই এ ড্রাগন চাষে এগিয়ে এসেছেন। এতে একদিকে কৃষকেরা যেমন লাভবান হচ্ছেন, তেমনি অন্যদিকে এলাকায় কিছুটা বেকারত্বও লাঘব হচ্ছে।

গোদাগাড়ীর গোগ্রামের ড্রাগন চাষী হেদায়েতুল হেলাল দৈনিক অগ্নিবাণী প্রতিবেদককে বলেন, ‘স্বল্প খরচ, ভালো উৎপাদন ও ব্যতিক্রমধর্মী ফল দেখে এর চাষে উদ্বুদ্ধ হয়েছি। বর্তমানে এর বাজারটাও বেশ ভালো। তাই হয়তো এই এলাকায় এটির চাষ বাড়ছে।’ কাকনহাট এলাকার আরেক ড্রাগন চাষী আশরাফুল আলম বলেন, ‘প্রথমদিকে ড্রাগনের পেছনে কিছুটা খরচ হলেও পরবর্তীতে তেমন খরচ করতে হয় না। বর্তমানে বাজারে চাহিদা অনেক বেশি, আবার লাভও ভালো। একারণে আমি সহ গোদাগাড়ী অঞ্চলের অনেকেই ড্রাগন চাষে ঝুকেছেন।’

রাজশাহীতে ড্রাগন চাষের বৃদ্ধি বিষয়ে রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মোজাহার হোসেনের দৈনিক অগ্নিবাণী প্রতিবেদককে বলেন, বরেন্দ্রভূমি রাজশাহীতে ড্রাগন চাষ বেশ লাভজনক। কারণ ড্রাগন হচ্ছে মরুভূমি এলাকার ফল। এদিক থেকে রাজশাহীর কিছু অঞ্চলের মাটি অধিকাংশ সময় খরা বা শুষ্ক থাকে। এসব এলাকায় পেয়ারা ও বড়ই এর আবাদ হয়। অন্য ফসল ভালো হয় না। আবার ড্রাগন চাষ সহজসাধ্য ও চাষে খরচও কম হয়। এ ফলে পোকামাকড় কম আক্রমণ করে আবার অতি বৃষ্টিতেও এর ক্ষতি হয় না। একারণে পূবের চেয়ে বর্তমানে এর আবাদ বেড়েছে। কাজেই এ অঞ্চলে ড্রাগন চাষ নিঃসন্দেহে লাভজনক।

অর্থনৈতিক সম্ভাবনার বিষয়ে তিনি বলেন, ড্রাগনের বাজার দর ২৫০-৪০০ টাকা কেজি। তবে কেউ যদি ঢাকার বাজারগুলোতে এটি পাঠাতে পারেন তবে দাম পাবেন কমপক্ষে ৫০০ টাকা কেজি। এর ‘ফুড ভ্যালু’ বেশ ভালো হওয়ায় অনেকেই ফ্রুটস এসোসিয়েশন বা নিজ উদ্যোগে বিদেশে রপ্তানি করছেন। শুধু তাই নয়, শহরাঞ্চলে এটি ছাদ বাগান ও উদ্যান চাষও হচ্ছে। আবার কেউ যদি এটিকে তার বারান্দার গ্রিলের পাশে একটি টবে লাগান তবে তার সাপোর্ট লাগবে না। এতে ওই বাড়ির সৌন্দর্য বৃদ্ধি পাবে এবং বাড়ির মালিক ফলও পাবেন বলে জানান এ কৃষি কর্মকর্তা।

অগ্নিবাণী/এফএ

Leave a Reply