পর্ব-১: রুয়েটের এক অধ্যাপককের জন্য তিন এমপি-মন্ত্রীর সুপারিশ

নিজস্ব প্রতিবেদক, রাজশাহী

গত ৩০ জুলাই শেষ হয় রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়ের (রুয়েট) ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম শেখের উপাচার্যের মেয়াদকাল। কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তাঁর মেয়াদকাল শেষ হবার এক বছর আগে থেকেই উপাচার্য পদে বসার জন্য দৌড়ঝাপ শুরু করেন রুয়েটের অধ্যাপক ড. নীরেন্দ্রনাথ মুস্তফী। পদটি বাগিয়ে নেবার জন্য ইতিমধ্যেই তিনি সংগ্রহ করেছেন তিনজন এমপি ও মন্ত্রী ডিও লেটার যা তাঁর তদবিরের কাজে জমা পড়েছে শিক্ষা মন্ত্রনালয়ে।

এছাড়াও গোপনসূত্রে জানা গেছে, কয়েকটি জাতীয় ও স্থানীয় রাজনৈতিক নেতার সুপারিশও রয়েছে তাঁর পক্ষে। শুধু তাই নয়, উপাচার্য পদটি পেতে তিনি ধর্ণা দিচ্ছেন বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছে।

শনিবার (৯ সেপ্টেম্বর) দৈনিক অগ্নিবাণী প্রতিবেদকের হাতে এ সংক্রান্ত বেশকিছু নথি হাতে আসে। এমপি ও মন্ত্রীর নথিগুলো পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ডিও লেটার গুলোর ভাষা হুবহু একই রকম। নওগাঁর এমপি ও খাদ্য মন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার, নওগাঁ-৩ আসনের এমপি মো. ছলিম উদ্দিন তরফদার ও রাজশাহী-২ আসনের এমপি ফজলে হোসেন বাদশা প্রফেসর ড. নীরেন্দনাথ মুস্তফীকে তাদের ডিও লেটারের মাধ্যমে সুপারিশ করেন।

ডিও লেটারে দেখা গেছে, ভিসির পদ প্রত্যাশী অধ্যাপক মুস্তফী মন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারের কাছে ২৭ জুলাই, ২০২২ তারিখে সুপারিশ নিলেও রাজশাহী ও নওগাঁর দুই এমপির কাছে থেকে ২৬ জুলাই, ২০২২ তারিখে ডিও লেটারে স্বাক্ষর করিয়েছেন।

ডিও লেটার গুলিতে উল্লেখ রয়েছে, ‘প্রফেসর নীরেন্দ্রনাথ মুস্তফী, সিনিয়র অধ্যাপক (গ্রেড-১), যন্ত্র প্রকৌশল বিভাগ, রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়, রাজশাহীতে কর্মরত আছেন। তিনি ব্যক্তিগতভাবে আমার সু-পরিচিত এবং আমার এলাকার গুনধর সন্তান। প্রফেসর ড. নীরেন্দনাথ মুস্তফী অত্র বিশ^বিদ্যালয়ে ১৯৯৮ সালে প্রভাষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। কর্মে যোগদানের পর থেকে অদ্যাবধি পর্যন্ত সুনামের সাথে শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে আসছেন। আমার জানামতে, তিনি ২০১২-১৩ সালে ভিজিটিং রিসার্চ ফেলো হিসেবে দ্যা ইউনিভারসিটি অব দ্যা ঘেন্ট বেলজিয়াম- তে তিন মাসের জন্য এবং ২০১৮-১৯ ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজি কানপুর, ইন্ডিয়াতে এক বছরের জন্য প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত হয়েছেন। তিনি একজন যন্ত্র প্রকৌশলবিদ ও গবেষক। তাঁর বেশকিছু গবেষণাকর্ম আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। তিনি রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধেও চেতনায় বিশ^াসী প্রগতিশীল শিক্ষকদের প্রত্যক্ষ ভোটে সভাপতি পদে নির্বাচিত হয়ে ২০১৬-১৮ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করছেন। এছাড়াও তিনি যন্ত্র কৌশল বিভাগের বিভাগীয় প্রধান, যন্ত্র প্রকৌশল অনুষদের ডীন, ইস্টিটিউটের পরিচালক হিসেবে সুনামের সাথে দায়িত্ব পালন করেন। গুনি এই প্রকৌশল শিক্ষাবিদকে উত্তরবঙ্গেও একমাত্র দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর পদে নিয়োগ প্রদান করা হলে তার পেশাগত দক্ষতা, অভিজ্ঞতা ও শৃজনশীল মেধার মাধ্যমে দেশের প্রকৌশল শিক্ষা বিস্তারে সূদুর প্রসারী ইতিবাচক এবং টেকসই সাফল্যসহ ২০৪১ সালের উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বির্নিমানে জোড়ালো ভূমিকা রাখতে পারবেন বলে আমার দৃঢ় বিশ^াস। আপনার অবগতির জন্য প্রফেসর ড. নীরেন্দ্রনাথ মুস্তফী এর জীবন বৃত্তান্ত এতদসঙ্গে সংযুক্ত করা হলো।’

‘এমতাবস্থায়, রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিদ্যালয়ের সিনিয়র প্রফেসর ড. নীরেন্দনাথ মুস্তফীকে ভাইস চ্যান্সেলর হিসেবে নিয়োগ প্রদানের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আপনার সদয় সানুগ্রহ দৃষ্টি ও সহযোগিতা প্রত্যাশা করছি বলেও সবশেয়ে উল্লেখ করা হয়েছে।’

ডিও লেটারে সুপারিশ করার বিষয়ে জানতে মুঠোফোনে কল করা হয় খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার ও নওগাঁ-৩ আসনের এমপি ছলিম উদ্দিন তরফতারকে। ফোন না ধরায় তাদের মন্তব্য মেলেনি। পরে তাদের মুঠোফোনে একটি ক্ষুদে বার্তা প্রদান করা হয়। এদিকে রাজশাহী-২ আসনের এমপি ফজলে হোসেন বাদশা চিকিৎসাজনিত কারণে ভারতে অবস্থান করায় তারও মন্তব্য নেওয়া যায়নি।

বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও ইউজিসির সদস্য অধ্যাপক ড. মো. আলগীর তিনি বলেন, ‘কোনো পাবলিক বিশ^বিদ্যালয়ে কোনো সুস্পষ্ট নীতিমালা নেই যে কিভাবে একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন ভিসিকে নিয়োগ দেওয়া হয়। সবাই জানে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে মাত্র তিনজনের নাম সিলেক্ট করা হয়। পরে তাদের মধ্যে থেকেই নির্বাচিত হয় কাঙ্খিত প্রতিষ্ঠানের ভিসি। তাই যে যার মতো তদবির বা সুপারিশ নিয়ে তাদের সিভি পাঠায় মন্ত্রণালয়ে।’

ভিসি পদ পাবার জন্য কোনো এমপি-মন্ত্রীর তদবির বা সুপারিশ শিক্ষা ব্যবস্থার ক্ষেত্রে কতটা নীতি নৈতিকতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং যৌক্তিক তা জানতে চাইলে তিনি গ্রীক দার্শনিক প্লেটোর একটি উক্তি দিয়ে বলেন, ‘মানুষ যখন পদ চাওয়ার চেয়ে পদ না পাওয়ার জন্য সুপারিশ করবে তখনই সে সমাজে নীতি-নৈতিকতা ও আদর্শের বিকাশ ঘটবে।’

‘যেহেতু উপাচার্য একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদ, উনি প্রশাসনিক ও একাডেমিক নির্বাহী প্রধান। উনি সার্বক্ষণিক ক্যাম্পাসেই থাকেন এবং উপাচার্যকে ঘিরেই একটা ক্যাম্পাসের সবকিছু নিয়ন্ত্রিত হয়। সুতরাং, এই পদে যিনি আসীন হবেন- তাকে একটা সুস্পষ্ট, সচ্ছ এবং সবার কাছে গ্রহণযোগ্য পদ্ধতির মাধ্যমেই আসতে হবে। যেমন করে চারটি সিনেট নির্বাচন করে’ বলেন এই ইউজিসির সদস্য।

উপাচার্য পদের জন্য এমপি-মন্ত্রীর সুপারিশের বিষয়ে রুয়েটের অধ্যাপক ড. নীরেন্দনাথ মুস্তফীকে বার বার তার মুঠোফোনে কল করেও পাওয়া যায়নি। পরে তার ব্যক্তিগত মোবাইল নম্বরে একটি ক্ষুদে বার্তা প্রদান করা হয়।

অগ্নিবাণী/এফএ

এই সংবাদটি শেয়ার করুন
Share on Facebook
Facebook
Tweet about this on Twitter
Twitter
Pin on Pinterest
Pinterest

Leave a Reply

Your email address will not be published.