রাজশাহীতে দুই প্রবাস ফেরত শ্রমিকের সোনার বার গায়েব করল পুলিশ
নিজস্ব প্রতিবেদক
কাতার ফেরৎ দুই শ্রমিকের সোনার দুটি বার গায়েবের অভিযোগ উঠেছে রাজশাহী নগরীর বোয়ালিয়া মডেল থানার ওসি ও এক এসআইয়ের বিরুদ্ধে। চারটি সোনার বারসহ গত ১ অক্টোবর রাজশাহী হয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ ফেরার পথে তাকে আটকান নগরীর বোয়ালিয়া মডেল থানার এসআই মতিন আহমেদ। পরে তাদের বিশেষ ক্ষমতা আইনের মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে চালান দেয় পুলিশ।
ভুক্তভোগী ওই দুই প্রবাসী হলেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার উপ রাজারামপুর কুমারপাড়া এলাকার মৃত মহসিন আলীর ছেলে আজিজুল ইসলাম (৪০) ও জেলার শিবগঞ্জ থানাধীন হরিনগর তাঁতিপাড়ার আব্দুল মঙলুর ছেলে ফারুক হোসেন (৩২)।
অভিযান পরিচালনাকারী এসআই মতিনেরও বাড়ি উপ রাজারামপুর কুমারপাড়া এলাকায়। তিনি প্রবাসী আজিজুল ইসলামের প্রতিবেশী।
প্রায় আড়াই বছর কাতারের দোহায় শ্রমিকের কাজ করেন তারা। চাকরি হারিয়ে শেষে গত ১ অক্টোবর ইউএস বাংলার বিএস-৩৩৪ নম্বর ফ্লাইটে সকাল ৮টায় শাহজালাল বিমানবন্দরে নামেন। এরপর তারা দেশ ট্রোভেল্স এর একটি যাত্রীবাহী বাসে (ঢাকা মেট্রো ব-১৫-২২৫১) চেপে গ্রামের বাড়ি ফিরছিলেন।
ওই দুই প্রবাসীর স্বজনদের অভিযোগ, থানার ওসি নিবারন চন্দ্র বর্মনের যোগসাজশে যোগসাজসে দুটি সোনার বার গায়েব করেছেন এসআই মতিন। মামলায় না দেয়া দুটি সোনার বার ফেরতের জন্য তাদের কাছ থেকে পাঁচ লাখ টাকাও নিয়েছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা আর ফেরত দেননি। উল্টো মামলায় চালান দিয়েছেন।
ভুক্তভোগী ওই দুই প্রবাসীর স্বজনরা জানান, গত ১ অক্টোবর আজিজুল ও ফারুক দুটি করে সোনার বার নিয়ে দেশে ফেরেন। নগরীর বর্ণালীর মোড় এলাকায় বাস থেকে তাদের নামিয়ে নেন এসআই মতিন।
পুলিশের সেদিনের সাজানো অভিযানে ছিলেন- বোয়ালিয়া মডেল থানার সেকেন্ড অফিসার এসআই শাহিন আখতার, মালোপাড়া পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ ইফতেখার মোহাম্মদ আলআমিন ও এটিএসআই মিনহাজুল। দীর্ঘদিন ধরেই তাদের বিরুদ্ধে ‘ফিটিং কেস’ ও ‘সামারি’ অভিযানের অভিযোগ আসছিলো। আর পুরো টিমের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন এসআই মতিন।
এসআই মতিনের বিরুদ্ধে পাহাড়সম অভিযোগ সত্ত্বেও দেখা গেছে বিভিন্ন সময় নগর পুলিশের শ্রেষ্ঠ উদ্ধারকারী অফিসারের খেতাব পান এসআই মতিন। আর গত আগস্টে নগর পুলিশের শ্রেষ্ঠ ওসি নির্বাচিত হন বোয়ালিয়া মডেল থানার ওসি নিরাবণ চন্দ্র বর্মন। মাঝে মধ্যেই নগরীর বোয়ালিয়া মডেল থানা শ্রেষ্ঠ ইউনিটের খেতাব অর্জন করে। যদিও শ্রেষ্টত্ব নির্ধারণের মানদন্ড নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে খোদ পুলিশের ভেতরেই।
জানা গেছে, সোনার বার নিয়ে ওই দুজনের দেশে ফেরার আগাম খবর ছিলো এসআই মতিনের কাছে। সোনা ও বিদেশ থেকে আনা মূল্যবান সামগ্রী কেড়ে নিতেই মতিন পরিকল্পিতভাবে তাদের আটকান। চারটি সোনার বার পেয়ে দুটি গায়েবও করে দেন।
এদিকে, দুই প্রবাসীর সোনা কেনার নথিপত্র এসেছে গণমাধ্যম কর্মীদের হাতে। সেটি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, তারা দেশে ফেরার আগের দিন কাতারের সুকসাউদ গোল্ড মার্কেটের গালফ জুয়েলারি থেকে চারটি চালানের মাধ্যমে সোনার বারগুলো কেনেন। ১০ তোলা ওজনের ২৪ ক্যারেট মানের প্রতিটি সোনার বার ২৬ হাজার ৫০০ কাতারি রিয়ালে কিনেছেন তারা।
ফারুকের নামে কেনা দুটি সেলস ইনভয়েস নম্বর দুটি হল ১৮২১৪৩ ও ১৮২১৪৩। আর আজিজুলের নামের সেলস ইনভয়েসের দুটি নম্বর যথাক্রমে ১৮২১৭০ ও ১৮২১৭১।
আটকের দিন রাতে আজিজুল বোয়ালিয়া থানা হেফাজতে থাকা অবস্থায় বলেন, সোনা আনলে বিমানবন্দরে জানাতে হয় এটা তাদের জানা ছিল না। তারা কোনো অসৎ উদ্দেশ্যে সোনা আনেননি।
তিনি বলেন, কাতারে তাদের চাকরি নেই। সেখানে তাদের আর ফেরা হবেনা। চিন্তা ছিলো দেশে গিয়ে ছোটখাটো ব্যবসা দাঁড় করানোর। এ জন্য দুটি করে সোনার বার কেনেন দুজন। দেশে এসে বাড়তি দামে বারগুলো বিক্রি করে ব্যবসায় নামতেন।
আজিজুলের স্ত্রী শরিফা খাতুন জানান, আটকের পরদিন এসআই মতিন তাদের প্রস্তাব দেন- দুটি সোনার বার দিয়ে মামলা দেয়া হবে। আর ৫ লাখ টাকা দিলে দুটি সোনার বার ফেরত দেয়া হবে।
তার প্রস্তাব মেনে আজিজুল ও ফারুকের স্বজনরা ২ অক্টোবর দুপুরে থানার দোতলায় মতিনের চেম্বারে গিয়ে নগদ ৫ লাখ টাকা তার হাতে দেন। এরপর সন্ধ্যার পর মাল ফেরত দেয়ার কথা বলে অপেক্ষা করতে বলেন।
কিন্তু সন্ধ্যার আগে আজিজুল ও ফারুককে দুটি সোনার বার দিয়ে আদালতে পাঠানোর পর এসআই মতিন মোবাইল ফোন বন্ধ করে থানা থেকে চলে যান।
৩ অক্টোবর এলাকার লোকজনসহ আজিজুলের স্ত্রী আবারও মতিনের কাছে এসে অন্তত: দুটি সোনা ফেরত দেয়ার জন্য তার হাতে পায়ে ধরেন। হাতিয়ে নেয়া ৫ লাখ টাকা ফেরত চাইলে ইয়াবা দিয়ে মামলায় ঢুকিয়ে দেয়ার ভয় দেখান মতিন।
শরিফা খাতুন আরো বলেন, তিনি ও তার পরিবার ন্যায়বিচারের আশায় পুলিশ কমিশনার বরাবর অভিযোগ দিতে চেয়েছিলেন। টের পেয়ে ৩ অক্টোবর এসআই মতিন তাকে ফোনে হুমকি দিয়েছেন। বলেছেন, অভিযোগ করলে রিমান্ডে এনে তোর স্বামীকে একবারেই খালাস করে দিব। স্বামীকে বাঁচাতে চাইলে মুখ বন্ধ রাখবি।
কথিত সোনা উদ্ধারের নামে দায়ের করা মামলার বাদি এসআই মতিন নিজেই। এজাহারে তিনি দাবি করেছেন, আজিজুল ও ফারুকের দেহ তল্লাশি করে দুটি সোনার বার পাওয়া গেছে। যার মূল্য ১৫ লাখ ১৫ হাজার ৮২৪ টাকা টাকা। শুল্ক ফাঁকি দিয়ে সোনা আনায় তাদের বিরুদ্ধে ১৯৭৪ সালের ২৫এর বি ধারায় মামলা রুজু হয়েছে। ওই মামলা আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে তাদের।
সোনার দুটি বার গায়েবের বিষয়ে জানতে চাইলে এসআই আবদুল মতিন বলেন, আসামিরা বিদেশ থেকে সোনা চোরাচালান করে এনেছে। এ অভিযোগে তাদের গ্রেফতার করে মামলা করা হয়েছে। তাদের কাছ থেকে টাকা নেয়ার অভিযোগি ভিত্তিহীন।
এবিষয়ে কয়েক দফা চেষ্টা করেও বোয়ালিয়া মডেল থানার ওসি নিবারণ চন্দ্র বর্মনের মোবাইল সংযোগ পাওয়া যায়নি। এর আগে এই ঘটনায় তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, দুইজনের কাছে দুটি সোনার বার পাওয়া যায়। দুটি দিয়েই মামলা দেয়া হয়েছে। সূত্র: যুগান্তর